ব্যবসা

ফ্রি লোন যা পরিশোধ করতে হবে না: একটি অর্থনৈতিক দিবাস্বপ্ন না বাস্তব সম্ভাবনা?

Free loans that don’t have to be repaid: a financial dream or a real possibility?

ভূমিকা:

“এমন যদি হতো, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আর পরিশোধ করতে হতো না!” – এই চিন্তাটি নিঃসন্দেহে বহু মানুষের মনে উঁকি দিয়েছে, বিশেষত অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে। সম্প্রতি, “ফ্রি লোন যা পরিশোধ করতে হবে না” – এই ধারণাটি বিভিন্ন মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এটি এক স্বপ্নের মতো, যা তাদের আর্থিক মুক্তির চাবিকাঠি হতে পারে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ এবং নীতি নির্ধারকদের কাছে বিষয়টি এতটা সহজ নয়। একটি দেশের অর্থনীতিতে এই ধরনের প্রকল্পের প্রভাব কী হতে পারে? সত্যিই কি এমন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এই প্রবন্ধে আমরা এই ধারণাটির বিভিন্ন দিক, এর সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারি প্রকল্পসমূহ, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং未来的 সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

“ফ্রি লোন” কি এবং কেন এই ধারণাটি এত আকর্ষণীয়?

“ফ্রি লোন” বলতে এমন এক ধরনের আর্থিক সহায়তাকে বোঝানো হচ্ছে যেখানে ঋণগ্রহীতাকে গৃহীত অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এটি প্রথাগত ঋণের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে মূলধনের সঙ্গে সুদ পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। এই ধারণাটির আকর্ষণের মূল কারণ হলো এটি মানুষকে তাৎক্ষণিক আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি দেয় এবং কোনো ভবিষ্যৎ দায়বদ্ধতা তৈরি করে না। বিশেষ করে, যে সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক বা ছাত্রছাত্রীরা মূলধনের অভাবে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না, তাদের কাছে এটি এক অসাধারণ সুযোগ বলে মনে হতে পারে।

বাস্তবে “ফ্রি লোন” বলে কি কিছু আছে?

সরাসরি “ফ্রি লোন যা পরিশোধ করতে হবে না” নামে কোনো সরকারি প্রকল্প বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে চালু নেই। তবে, এই ধারণার কাছাকাছি কিছু সরকারি পদক্ষেপ বা প্রকল্প লক্ষ্য করা যায়, যেগুলিকে সাধারণ মানুষ অনেক সময় “ফ্রি লোন” বলে ভুল করে থাকে। এগুলি মূলত ঋণ মকুব, অনুদান বা ভর্তুকির আকারে প্রদান করা হয়।

  • ঋণ মকুব (Loan Waiver): এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সরকার বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট শ্রেণীর ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের দায় থেকে মুক্তি দেয়। ভারতে, বিশেষত কৃষি ক্ষেত্রে, ঋণ মকুব একটি বহুল প্রচলিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলের ক্ষতি বা কৃষকদের চরম দুর্দশার সময়ে সরকার কৃষি ঋণ মকুবের ঘোষণা করে থাকে। ২০০৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে কৃষি ঋণ মকুব যোজনা চালু করেছিল, যা বহু কৃষককে স্বস্তি দিয়েছিল। তবে, এটি কোনো প্রারম্ভিক “ফ্রি লোন” নয়, বরং 이미 নেওয়া ঋণের পরিশোধের অক্ষমতার প্রেক্ষাপটে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
  • সরকারি অনুদান (Grants): অনুদান হলো এক ধরনের আর্থিক সহায়তা যা কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রদান করা হয় এবং এটি ফেরতযোগ্য নয়। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে, যেমন – ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, বা নারী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য সরকার অনুদান প্রদান করে থাকে। এই অনুদানগুলি ব্যবসার সরঞ্জাম ক্রয়, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বা অন্যান্য নির্দিষ্ট খরচের জন্য ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের “গতিধারা” প্রকল্পের মতো উদ্যোগে যেখানে যানবাহন কেনার জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়, তাকেও একপ্রকার অনুদান বলা যেতে পারে। এটি সরাসরি নগদ “ফ্রি লোন” না হলেও, এর অর্থনৈতিক প্রভাব অনেকটাই একই রকম।
  • ভর্তুকিযুক্ত ঋণ (Subsidized Loans): এই প্রকল্পগুলিতে ঋণের সুদের একটি বড় অংশ সরকার বহন করে, ফলে ঋণগ্রহীতাকে খুব কম সুদে বা বিনাসুদে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা বা স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মতো প্রকল্পগুলি এর অন্যতম উদাহরণ। এখানে ঋণগ্রহীতাকে মূলধন ফেরত দিতে হলেও, সুদের বোঝা অনেকটাই লাঘব হয়, যা তাদের জন্য ঋণ পরিশোধকে অনেক সহজ করে তোলে।

“ফ্রি লোন” বা ঋণ মকুবের অর্থনৈতিক প্রভাব:

“ফ্রি লোন” বা ঋণ মকুবের ধারণাটি সাময়িকভাবে জনপ্রিয়তা পেলেও, এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য রয়েছে।

ইতিবাচক দিক:

১. চাহিদা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের হাতে সরাসরি অর্থ এলে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে পারে।

২. দারিদ্র্য হ্রাস: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এই ধরনের আর্থিক সহায়তা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।

৩. নতুন উদ্যোগের সৃষ্টি: মূলধনের অভাবে যে সমস্ত উদ্যোগপতিরা ব্যবসা শুরু করতে পারছিলেন না, তারা নতুন ব্যবসা শুরু করার সুযোগ পাবেন, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

৪. সামাজিক সুরক্ষা: কৃষকদের আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা রোধ করতে এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করতে ঋণ মকুবের মতো পদক্ষেপ কার্যকরী হতে পারে।

নেতিবাচক দিক:

১. রাজকোষের উপর বিপুল চাপ: “ফ্রি লোন” বা ঋণ মকুবের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে সরকারের রাজকোষের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে। এর ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিকাঠামোর মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারি ব্যয় কমাতে হতে পারে।

২. ক্রেডিট কালচারের অবনতি: যদি মানুষ মনে করে যে ঋণ পরিশোধ না করলেও চলবে, তাহলে দেশের সার্বিক ক্রেডিট কালচার বা ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাবে। এর ফলে, ব্যাংকগুলি ভবিষ্যতে ঋণ দিতে দ্বিধা বোধ করবে এবং যোগ্য ঋণগ্রহীতারাও ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন।

৩. মুদ্রাস্ফীতি: বাজারে হঠাৎ করে টাকার জোগান বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দেবে।

৪. রাজনৈতিক হাতিয়ার: প্রায়শই দেখা যায়, ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলি ঋণ মকুবের মতো প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি একটি সুস্থ অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।

৫. অযোগ্যদের সুবিধা প্রাপ্তি: অনেক সময় দেখা যায়, এই ধরনের প্রকল্পের সুবিধা অযোগ্য ব্যক্তিরা বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পেয়ে থাকেন, এবং প্রকৃত দুঃস্থ মানুষরা বঞ্চিত হন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত:

অর্থনীতিবিদ ডঃ অভিজিৎ সেনের মতে, “সরাসরি ফ্রি লোন দেওয়ার ধারণাটি অর্থনৈতিকভাবে অবাস্তব এবং বিপজ্জনক। এর পরিবর্তে, সরকারের উচিত এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে মানুষ কম সুদে এবং সহজে ঋণ পেতে পারে এবং সেই ঋণ ব্যবহার করে নিজেদের আয় বাড়াতে পারে।”

অন্যদিকে, সমাজকর্মী এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ শ্রীমতী দেবিকা রায়ের মতে, “আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি আর্থিক সহায়তা বা অনুদানের প্রয়োজন আছে। তবে, সেটি হতে হবে অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং লক্ষ্যভিত্তিক, যাতে তার অপব্যবহার না হয় এবং সেটি যেন তাদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে, পরনির্ভরশীল না করে তোলে।”

রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) বারবার ঋণ মকুব প্রকল্পের বিরোধিতা করে এসেছে, কারণ এটি ব্যাংকগুলির আর্থিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে দেয় এবং ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বিকল্প পথ কী হতে পারে?

“ফ্রি লোন”-এর মতো অবাস্তব ধারণার পরিবর্তে, সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে যা মানুষের আর্থিক অবস্থাকে উন্নত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে।

  • সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা: সকলের জন্য, বিশেষত কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং ছাত্রদের জন্য, সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।
  • দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ: মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, যাতে তারা নিজেরাই আয় করতে পারে এবং ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমে।
  • শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা বলয়: বেকার ভাতা, স্বাস্থ্য বীমা এবং বার্ধক্য ভাতার মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে আরও শক্তিশালী করা, যাতে মানুষ আর্থিক সংকটের সময় সহায়তা পায়।
  • অনুদান এবং ভর্তুকির সঠিক ব্যবহার: অনুদান বা ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং সঠিক তদারকির ব্যবস্থা করা, যাতে শুধুমাত্র যোগ্য ব্যক্তিরাই এই সুবিধা পান এবং এর সঠিক ব্যবহার হয়।

উপসংহার:

“ফ্রি লোন যা পরিশোধ করতে হবে না” – এই ধারণাটি নিঃসন্দেহে একটি ইউটোপিয়ান বা কাল্পনিক ধারণা, যা আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ একটি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারে। এটি একটি টেকসই অর্থনৈতিক মডেল নয়। তবে, এই আলোচনার মাধ্যমে যে মূল প্রশ্নটি উঠে আসে, তা হলো – কীভাবে দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক মুক্তি ঘটানো সম্ভব? উত্তরটি “ফ্রি লোন”-এর মধ্যে লুকিয়ে নেই, বরং তা লুকিয়ে আছে এক সুস্থ, সবল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলার মধ্যে, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করার এবং আয় করার সুযোগ পাবে এবং প্রয়োজনের সময় রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়াবে এক শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। ঋণ মকুব বা অনুদানের মতো পদক্ষেপগুলি শুধুমাত্র আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত, দীর্ঘমেয়াদী নীতি হিসেবে নয়। ভবিষ্যতের পথ হওয়া উচিত মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা, পরনির্ভরশীল নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *