Blogশিক্ষা

SSC Supreme Court: কাদের চাকরি বাতিল হল না? কাদের বেতন ফেরত দিতে হবে? জাজমেন্ট কি বলছে দেখুন

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় ধাক্কা এসেছে যখন সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের SSC (স্কুল সার্ভিস কমিশন) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত প্রায় ২৫,০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করার কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে বহাল রেখেছে। ৩ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এই রায়টি শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রভাবিত কর্মীদের জীবন এবং রাজ্য সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

SSC Supreme Court

SSC Supreme Court

পটভূমি: SSC নিয়োগ কেলেঙ্কারির শুরু

২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (ডব্লিউবি এসএসসি) রাজ্যের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের জন্য স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি) আয়োজন করে। এই প্রক্রিয়ায় মোট ২৩ লাখ প্রার্থী আবেদন করেছিলেন ২৪,৬৪০টি শূন্যপদের জন্য। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল ২৫,৭৫৩ জনকে, যা অনুমোদিত শূন্যপদের সংখ্যার চেয়ে বেশি। এই অসঙ্গতি থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ওএমআর শিটে কারচুপি, র‍্যাঙ্কে হেরফের, এমনকি যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার মতো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয় এবং ২২ এপ্রিল, ২০২৪-এ বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও মোহাম্মদ শাব্বার রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ পুরো প্যানেল বাতিল করার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এসএসসি এবং কিছু প্রভাবিত কর্মী সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায়।

সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শুরু হয় ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত চলে। ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ রায় সংরক্ষিত হয় এবং অবশেষে ৩ এপ্রিল, ২০২৫-এ চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হয়।


সুপ্রিম কোর্টের রায়: কী বলা হলো?

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়েছে, “নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে দূষিত হয়েছে। এখানে এমনভাবে কারচুপি ও জালিয়াতি হয়েছে যে এটি মেরামতের বাইরে চলে গেছে। পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।” এই কথাগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে আদালত এই দুর্নীতিকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে।

  • প্যানেল বাতিল: ২০১৬ সালের এসএলএসটি থেকে নিযুক্ত সব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করা হয়েছে।
  • নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া: রাজ্য সরকারকে তিন মাসের মধ্যে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
  • বেতন ফেরত: যদিও হাইকোর্ট নিয়োগপ্রাপ্তদের বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট এই শর্ত শিথিল করে বলেছে যে কাউকে বেতন ফেরত দিতে হবে না। এটি প্রভাবিত কর্মীদের জন্য একটি বড় স্বস্তি।
  • প্রতিবন্ধী কর্মীদের জন্য সুবিধা: মানবিক কারণে প্রতিবন্ধী কর্মীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হবে না। তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে।
  • সিবিআই তদন্ত: হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সিবিআই তদন্ত চলবে, তবে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট এই তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

কারা চাকরিতে থাকতে পারবেন?

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। যারা প্রতিবন্ধী শ্রেণির কর্মী এবং ২০১৬ সালের নিয়োগে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি বহাল থাকবে। আদালত এই সিদ্ধান্তকে “মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। এর ফলে প্রায় কয়েকশো কর্মী তাদের চাকরি ধরে রাখতে পারবেন। তবে এই সংখ্যা খুবই সীমিত।

এছাড়া, যদি কোনো কর্মীর নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ম মেনে হয়েছে এবং তারা এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন বলে প্রমাণিত হয়, তবে ভবিষ্যতে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে এটি এখনো স্পষ্ট নয় এবং সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে।


কারা বঞ্চিত হলেন?

এই রায়ের ফলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন সেই ২৫,০০০-এর বেশি শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, যারা ২০১৬ সালের এসএলএসটি-র মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো নিজেরা কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি দূষিত হওয়ায় তাদের চাকরি হারাতে হচ্ছে। এই কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন:

  • অতিরিক্ত নিয়োগপ্রাপ্তরা: যেহেতু ২৪,৬৪০টি শূন্যপদের বিপরীতে ২৫,৭৫৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অতিরিক্ত নিযুক্তদের চাকরি স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হয়েছে।
  • কারচুপির শিকার: যাদের নিয়োগে ওএমআর শিটে হেরফের বা র‍্যাঙ্কে পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তারা সরাসরি প্রভাবিত।
  • সাধারণ কর্মীরা: যারা সৎভাবে চাকরি পেয়েছিলেন বলে দাবি করেন, তারাও এই রায়ের আওতায় এসেছেন, কারণ আদালত পুরো প্যানেলটিকেই বাতিল করেছে।

এই বঞ্চনার ফলে অনেক পরিবার আর্থিক সংকটে পড়তে পারে। গত আট বছর ধরে এই চাকরির ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করা অনেকের জন্য এটি একটি বড় আঘাত।


প্রভাবিতদের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো?

সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বস্তি ও ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছে, যা প্রভাবিত কর্মীদের জন্য আশার আলো হতে পারে। আসুন দেখে নিই:

  1. বেতন ফেরতের বাধ্যবাধকতা নেই: হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল যে অবৈধভাবে নিযুক্তরা গত আট বছরের বেতন ফেরত দেবেন, এমনকি ১২% সুদসহ। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই শর্ত তুলে দিয়েছে। এটি হাজার হাজার পরিবারের জন্য একটি বড় আর্থিক স্বস্তি।
  2. নতুন নিয়োগের সুযোগ: আদালত রাজ্য সরকারকে তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে বলেছে। এতে যারা এই চাকরি হারাচ্ছেন, তারা আবার পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। তবে বয়সসীমা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, যা সরকারের পরবর্তী বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট হবে।
  3. প্রতিবন্ধীদের জন্য ছাড়: যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবন্ধী কর্মীদের চাকরি বহাল রাখা হয়েছে। এটি একটি মানবিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
  4. সিবিআই তদন্তের ধারাবাহিকতা: দুর্নীতির মূল কারণ ও দায়ীদের খুঁজে বের করতে সিবিআই তদন্ত চলবে। এটি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে সাহায্য করতে পারে।

সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব

এই রায়ের প্রভাব শুধু প্রভাবিত কর্মীদের ওপরই সীমাবদ্ধ নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করবে। ২৫,০০০-এর বেশি শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী হারানোর ফলে স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকট দেখা দিতে পারে। নতুন নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে, এই রায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা দিয়েছে। এটি ভবিষ্যতে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।


রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

রায় ঘোষণার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলেছিলেন, “এই রায় ১.৫ থেকে ২ লাখ পরিবারকে প্রভাবিত করবে। আমরা এর বিরুদ্ধে লড়ব।” তৃণমূল কংগ্রেস এই রায়কে “শিক্ষকদের ওপর আঘাত” হিসেবে বর্ণনা করেছে। অন্যদিকে, বিজেপি ও সিপিএম এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জয়।

সাধারণ মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকে এই রায়কে ন্যায়বিচারের জয় বলে মনে করছেন, আবার অনেকে প্রভাবিত কর্মীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।


উপসংহার: ভবিষ্যৎ কী হবে?

এসএসসি নিয়োগ কেলেঙ্কারি এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে। যদিও এটি অনেকের জন্য কঠিন সময় নিয়ে এসেছে, তবু এটি স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের পথে একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্রভাবিত কর্মীদের জন্য নতুন সুযোগ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি এখন সরকারের হাতে।

আপনি যদি এই বিষয়ে আরও জানতে চান বা আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে কমেন্টে জানান। আমাদের ওয়েবসাইটে এমন আরও আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *